রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট কবিতা

১০। বীরপুরুষ

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেকদুরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে

টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে

রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে

সন্ধ্যে হোলো, তূর্ষ নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদীঘির মাঠে।
ধুধু করে যে-দিক পাঁনে চাই,
কোনোখানে জন-মানব নাই,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ, ভাবছ, এলেম কোথা,
আমি বলছি–ভয় কোরো না মা গো
এ দেখা যায় মর! নদীর সৌতা।

চোর-কাটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরুবাছুর নাইকো! কোনোখানে,
সন্ধ্যে হোতেই গেছে গায়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
“দীঘির ধারে এ যে কিসের আলো ”

এমন সময় “হারে রে রে রে রে,”

এ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।–
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাটা-বনে

পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো,
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে

“আমি আছি ভয় কেন মা করো ।”

হাতে-লাঠি মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
কানে তাদের গৌজ। জবার ফুল ।
আমি বলি, পাড়া, খবরদার ;
এক পা কাছে আসিস যদি আর

এই চেয়ে দেখ আমার ও লোয়ার ..!
টুকরো করে দেব তোদের সুরে ্

শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে সি |
ডেঁচিয়ে উঠল “হারে রে রে রে ট

তুমি বললে, “যাসনে বুক ওরে,”
আমি বলি, “দেখো না চুপ পট ।
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলাম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হোলো মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাট।।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা ।

এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি ম’রে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, “লড়াই গেছে থেমে”,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে;
বলছ,“ভাগ্যে খোক। সঙ্গে ছিল
কী দদদশাই হোত তা না হোলে।”

রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা–
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা ।
ঠিক যেন এক গল্প হোত তবে,
শুনত যার। অবাক হোত সবে,
দাদা বলত “কেমন ক’রে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে ।”
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
“ভাগ্যে খোকা! ছিল মায়ের কাছে ॥


Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *