পোস্টমাস্টার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পোস্টমাস্টার গল্পের পটভূমিকাঃ

“পোস্টমাস্টার” একটি শহরের বংশোদ্ভূত লোকের একাকীত্বের একটি খুব মর্মস্পর্শী বিবরণ দেয় যিনি একটি প্রত্যন্ত এবং নিঃসঙ্গ গ্রামে পোস্টমাস্টার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তাকে জলের বাইরে মাছের মতো মনে হলো। ধীরে ধীরে দাসী রতনের সাথে তার স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তিনি প্রায়ই বাড়িতে ফিরে তার পারিবারিক জীবনের কথা বলতেন। তার একাকীত্বের সাথে লড়াই করার জন্য তিনি কবিতা লিখতেন এবং তাকে বই পড়তে শেখাতেন। একদিন পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং রতন একজন স্তন্যদানকারী মায়ের মতো তাকে দেখাশোনা করলেন এবং তাকে অনেক সাহায্য করলেন।

তার হৃদয় এবং স্থানের একাকীত্বে বিরক্ত হয়ে অবশেষে তিনি তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পোস্টমাস্টার কলকাতায় চলে গেলেন কিন্তু রতন পোস্ট অফিসে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন এই আশায় যে তার মাস্টার একদিন ফিরে আসবেন।

পোস্টমাস্টারের সাথে একটি দৃঢ় মানসিক বন্ধন তার হৃদয়ে গড়ে উঠেছিল এবং সে ভাবতে থাকে যে তারও তার প্রতি অনুরূপ অনুরাগ রয়েছে।

গল্পটি দুই ব্যক্তির করুণ কাহিনী। উভয়ই দুঃখী এবং বেদনাদায়ক – একটি একাকীত্বের কারণে এবং কারণ তিনি তার প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন; অন্যটি কারণ তাকে পিছনে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং যার সাথে তার সংযুক্তির তীব্র অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সে চলে গেছে এবং তার জন্য যত্নশীল বলে মনে হচ্ছে না।

গল্পটি ছোট গ্রামের মেয়ের প্রেমের অসারতা এবং তাকে যে করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা দেখানো হয়েছে।

গল্পটি নিম্নে বর্ণিত হল।

পোস্টমাস্টার

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্ট্‌আপিস স্থাপন করাইয়াছে।

আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যেরকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্ট্‌মাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।

বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই। কখনো কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায়— কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।

পোস্ট্‌মাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না।

সন্ধ্যার সময় যখন গ্রামের গোয়ালঘর হইতে ধূম কুণ্ডলায়িত হইয়া উঠিত, ঝোপে ঝোপে ঝিল্লি ডাকিত, দূরে গ্রামের নেশাখোর বাউলের দল খোল-করতাল বাজাইয়া উচ্চৈঃস্বরে গান জুড়িয়া দিত— যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত, তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জ্বালিয়া পোস্টমাস্টার ডাকিতেন— ‘রতন’। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসিত না; বলিত, “কী গা বাবু, কেন ডাকছ।”

পোস্টমাস্টার। তুই কী করছিস।

রতন। এখনই চুলো ধরাতে যেতে হবে— হেঁশেলের—

পোস্টমাস্টার। তোর হেঁশেলের কাজ পরে হবে এখন— একবার তামাকটা সেজে দে তো।

অনতিবিলম্বে দুটি গাল ফুলাইয়া কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে রতনের প্রবেশ। হাত হইতে কলিকাটা লইয়া পোস্টমাস্টার ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে?” সে অনেক কথা; কতক মনে পড়ে, কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ তাহাকে বেশি ভালোবাসিত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। পরিশ্রম করিয়া বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়া আসিত, তাহারই মধ্যে দৈবাৎ দুটি-একটি সন্ধ্যা তাহার মনে পরিষ্কার ছবির মতো অঙ্কিত আছে। এই কথা হইতে হইতে ক্রমে রতন পোস্ট্‌মাস্টারের পায়ের কাছে মাটির উপর বসিয়া পড়িত। মনে পড়িত, তাহার একটি ছোটোভাই ছিল— বহু পূর্বেকার বর্ষার দিনে একদিন একটা ডোবার ধারে দুইজনে মিলিয়া গাছের ভাঙা ডালকে ছিপ করিয়া মিছামিছি মাছধরা খেলা করিয়াছিল— অনেক গুরুতর ঘটনার চেয়ে সেই কথাটাই তাহার মনে বেশি উদয় হইত। এইরূপ কথাপ্রসঙ্গে মাঝে মাঝে বেশি রাত হইয়া যাইত, তখন আলস্যক্রমে পোস্ট্‌মাস্টারের আর রাঁধিতে ইচ্ছা করিত না। সকালের বাসি ব্যঞ্জন থাকিত এবং রতন তাড়াতাড়ি উনুন ধরাইয়া খানকয়েক রুটি সেঁকিয়া আনিত— তাহাতেই উভয়ের রাত্রের আহার চলিয়া যাইত।

এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সেই বৃহৎ আটচালার কোণে আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্টমাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন— ছোটোভাই মা এবং দিদির কথা, প্রবাসে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিত তাহাদের কথা। যে-সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিতা ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হইত না। অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথন-কালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা দিদি দাদা বলিয়া চিরপরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমনকি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাঁহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।

একদিন বর্ষাকালের মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল; রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল; মনে হইতেছিল, যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস গায়ের উপরে আসিয়া লাগিতেছে; এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা পাখি তাহার একটা একটানা সুরের নালিশ সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতির দরবারে অত্যন্ত করুণস্বরে বারবার আবৃত্তি করিতেছিল। পোস্ট্‌মাস্টারের হাতে কাজ ছিল না— সেদিনকার বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরুপল্লবের হিল্লোল এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখিবার বিষয় ছিল; পোস্টমাস্টার তাহা দেখিতেছিলেন এবং ভাবিতেছিলেন, এই সময় কাছে একটি-কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত— হৃদয়ের সহিত একান্তসংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি। ক্রমে মনে হইতে লাগিল, সেই পাখি ওই কথাই বারবার বলিতেছে এবং এই জনহীন তরুচ্ছায়ানিমগ্ন মধ্যাহ্নের পল্লবমর্মরের অর্থও কতকটা ওইরূপ। কেহ বিশ্বাস করে না, এবং জানিতেও পায় না, কিন্তু ছোটো পল্লীর সামান্য বেতনের সাব-পোস্ট্‌মাস্টারের মনে গভীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে দীর্ঘ ছুটির দিনে এইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়া থাকে।

পোস্টমাস্টার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিলেন ‘রতন’। রতন তখন পেয়ারাতলায় পা ছড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছিল; প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয়া আসিল— হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “দাদাবাবু, ডাকছ?” পোস্টমাস্টার বলিলেন, “তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব।” বলিয়া সমস্ত দুপুরবেলা তাহাকে লইয়া ‘স্বরে অ’ ‘স্বরে আ’ করিলেন। এবং এইরূপে অল্পদিনেই যুক্ত-অক্ষর উত্তীর্ণ হইলেন।

শ্রাবণ মাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ— নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।

একদিন প্রাতঃকাল হইতে খুব বাদলা করিয়াছে। পোস্ট্‌মাস্টারের ছাত্রীটি অনেকক্ষণ দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো যথাসাধ্য নিয়মিত ডাক শুনিতে না পাইয়া আপনি খুঙ্গিপুঁথি লইয়া ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, পোস্টমাস্টার তাঁহার খাটিয়ার উপর শুইয়া আছেন— বিশ্রাম করিতেছেন মনে করিয়া অতি নিঃশব্দে পুনশ্চ ঘর হইতে বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল। সহসা শুনিল— ‘রতন’। তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গিয়া বলিল, “দাদাবাবু, ঘুমোচ্ছিলে?” পোস্টমাস্টার কাতরস্বরে বলিলেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না— দেখ্ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।”

এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারী-রূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে, এবং এ স্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”

বহুদিন পরে পোস্টমাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন; মনে স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে। স্থানীয় অস্বাস্থ্যের উল্লেখ করিয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় কর্তৃপক্ষদের নিকট বদলি হইবার জন্য দরখাস্ত করিলেন।

রোগসেবা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রতন দ্বারের বাহিরে আবার তাহার স্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু পূর্ববৎ আর তাহাকে ডাক পড়ে না। মাঝে-মাঝে উঁকি মারিয়া দেখে, পোস্টমাস্টার অত্যন্ত অন্যমনস্কভাবে চৌকিতে বসিয়া অথবা থাটিয়ায় শুইয়া আছেন। রতন যখন আহ্বান প্রত্যাশা করিয়া বসিয়া আছে, তিনি তখন অধীরচিত্তে তাঁহার দরখাস্তের উত্তর প্রতীক্ষা করিতেছেন। বালিকা দ্বারের বাহিরে বসিয়া সহস্রবার করিয়া তাহার পুরানো পড়া পড়িল। পাছে যেদিন সহসা ডাক পড়িবে সেদিন তাহার যুক্ত-অক্ষর সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, এই তাহার একটা আশঙ্কা ছিল। অবশেষে সপ্তাহখানেক পরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাক পড়িল। উদ্বেলিতহদয়ে রতন গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “দাদাবাবু, আমাকে ডাকছিলে?”

পোস্টমাস্টার বলিলেন, “রতন, কালই আমি যাচ্ছি।”

রতন। কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।

পোস্টমাস্টার। বাড়ি যাচ্ছি।

রতন। আবার কবে আসবে।

পোস্টমাস্টার। আর আসব না।

রতন আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। পোস্টমাস্টার আপনিই তাহাকে বলিলেন, তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন, দরখাস্ত নামঞ্জুর হইয়াছে; তাই তিনি কাজে জবাব দিয়া বাড়ি যাইতেছেন। অনেকক্ষণ আর কেহ কোনো কথা কহিল না। মিট্‌মিট্ করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ্‌টপ্ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পরে রতন আস্তে আস্তে উঠিয়া রান্নাঘরে রুটি গড়িতে গেল। অন্য দিনের মতো তেমন চট্‌পট্ হইল না। বোধ করি মধ্যে মধ্যে মাথায় অনেক ভাবনা উদয় হইয়াছিল। পোস্ট্‌মাস্টারের আহার সমাপ্ত হইলে পর বালিকা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?”

পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে।” ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না।

সমস্ত রাত্রি স্বপ্নে এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্ট্‌মাস্টারের হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর বাজিতে লাগিল— ‘সে কী করে হবে’।

ভোরে উঠিয়া পোস্টমাস্টার দেখিলেন, তাঁহার স্নানের জল ঠিক আছে; কলিকাতার অভ্যাস-অনুসারে তিনি তোলা জলে স্নান করিতেন। কখন তিনি যাত্রা করিবেন সে কথা বালিকা কী কারণে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই; পাছে প্রাতঃকালে আবশ্যক হয় এইজন্য রতন তত রাত্রে নদী হইতে তাঁহার স্নানের জল তুলিয়া আনিয়াছিল। স্নান সমাপন হইলে রতনের ডাক পড়িল। রতন নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং আদেশপ্রতীক্ষায় একবার নীরবে প্রভুর মুখের দিকে চাহিল। প্রভু কহিলেন, “রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।” এই কথাগুলি যে অত্যন্ত স্নেহগর্ভ এবং দয়ার্দ্র হৃদয় হইতে উত্থিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু নারীহৃদয় কে বুঝিবে। রতন অনেকদিন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য করিয়াছে কিন্তু এই নরম কথা সহিতে পারিল না। একেবারে উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না না, তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।”

পোস্টমাস্টার রতনের এরূপ ব্যবহার কখনও দেখেন নাই, তাই অবাক হইয়া রহিলেন।

নূতন পোস্টমাস্টার আসিল। তাহাকে সমস্ত চার্জ বুঝাইয়া দিয়া পুরাতন পোস্টমাস্টার গমনোন্মুখ হইলেন। যাইবার সময় রতনকে ডাকিয়া বলিলেন, “রতন, তোকে আমি কখনও কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।”

কিছু পথখরচ বাদে তাঁহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধূলায় পড়িয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না”— বলিয়া এক-দৌড়ে সেখান হইতে পলাইয়া গেল।

ভূতপূর্ব পোস্টমাস্টার নিশ্বাস ফেলিয়া, হাতে কার্পেটের ব্যাগ ঝুলাইয়া, কাঁধে ছাতা লইয়া, মুটের মাথায় নীল ও শ্বেত রেখায় চিত্রিত টিনের পেঁটরা তুলিয়া ধীরে ধীরে নৌকাভিমুখে চলিলেন।

যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন— একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি’— কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে— এবং নদী প্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্ট্‌আপিস গৃহের চারি দিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে— সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না। হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।


সারসংক্ষেপ পোস্টমাস্টার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:

পোস্টমাস্টার, একজন শহরের বংশোদ্ভূত লোক কলকাতার বাসিন্দা। তিনি উলাপুরের ছোট্ট গ্রামে দায়িত্ব নেন। একটি নীল কারখানা ছিল যার স্বত্বাধিকারী (মালিক), একজন ইংরেজ সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একটি ডাকঘর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।

পোস্টমাস্টার একটি ঘন (ঘন) বৃদ্ধি দ্বারা বেষ্টিত একটি গাঢ় খড়ের শেডে থাকতেন এবং কাজ করতেন। তিনি সেখানে একাকী বোধ করেছিলেন কারণ তার খুব বেশি কাজ ছিল না এবং তার সাথে খুব কম সঙ্গ ছিল। তাই সময়কে কাজে লাগাতে এবং একাকীত্ব এড়াতে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। তার বেতন অল্প ছিল এবং তাই তাকে নিজের খাবার রান্না করতে হতো। গ্রামের অনাথ মেয়ে রতন – দাসীর সাথে খাবার ভাগাভাগি করে নিতেন।

পোস্টমাস্টার আর মেয়েটা একটু কথা বলল। প্রায়ই সন্ধ্যায় পোস্টমাস্টার তার ছোট্ট বাতি জ্বালিয়ে রতনকে ডাকতেন যে তার ডাকের অপেক্ষায় বাইরে বসে আছে। তিনি তাকে তার প্রদীপ জ্বালাতে বলবেন। যখন সে তা করেছিল, তখন এটি তাকে তার সাথে কথা বলার সুযোগ দেবে।

তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, রতন তার মায়ের পুরানো স্মৃতির ভিত্তিতে তার অতীতের কথা বলত। সে তার বাবার কথা আরও প্রাণবন্ত মনে করল। সে পোস্টমাস্টারের পায়ের কাছে মেঝেতে বসবে এবং তার সামনে তার ভিড়ের স্মৃতি ঢেলে দেবে।

সে তার ভাইয়ের কথাও মনে রাখবে যার সাথে সে পুকুরের ধারে মাছ ধরত। এই ধরনের মিথস্ক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং পোস্টমাস্টার রান্না করতে দেরী করবে। রতন অবশেষে উঠে সকালের নাস্তার অবশিষ্ট কিছু খামিরবিহীন রুটি টোস্ট করবে এবং পোস্টমাস্টারকে দেবে যা তার রাতের খাবারের জন্য যথেষ্ট ছিল।
কখনও কখনও পোস্টমাস্টার খুব অসুস্থ বোধ করেন কারণ তিনি তার বাড়ি, তার মা এবং তার বোনকে তীব্রভাবে মিস করতেন। এই স্মৃতিগুলো তাকে বারবার তাড়িত করে তার একাকীত্বে। তিনি, মাঝে মাঝে, সরল ছোট মেয়ের সামনে তাদের উচ্চস্বরে স্মরণ করতেন। রতন শীঘ্রই অনুভব করল যে সে তাদের সারাজীবন জেনেছে। তার হৃদয়ে তাদের একটি সম্পূর্ণ ছবি ছিল।

একদিন দুপুরে বৃষ্টির বিরতির সময়, পোস্টমাস্টার “কিছু আত্মীয় আত্মার” নৈকট্য কামনা করেছিলেন যে তাকে ভালবাসতে পারে। কিন্তু এর অনুপস্থিতি তাকে খুবই দুঃখ দিয়েছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতনকে ডাকল যে পেয়ারা গাছের নিচে পাকা পেয়ারা খাচ্ছে। পোস্টমাস্টার তাকে বলেছিলেন যে তিনি তাকে পড়তে এবং লিখতে শেখাবেন। খুব অল্প সময়ে রতন দ্বিগুণ ব্যঞ্জনবর্ণ শিখতে পেরেছিল।


বিশেষ দিনে বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয়নি। দিনরাত বৃষ্টি হলে সব খানা-খন্দ, খাল-বিল পানিতে প্লাবিত হয়। সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এক ঘন মেঘাচ্ছন্ন সকালে রতন তার মালিকের ডাকের অপেক্ষায় রইল। পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে কোনো বার্তা না পেয়ে সে উঠে বই হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে দেখল তার দাদা বিছানায় শুয়ে আছেন।

যখন তিনি ফিরে যেতে শুরু করলেন, পোস্টমাস্টার তাকে বললেন যে তিনি অসুস্থ। তার একাকীত্ব, তার একটু কোমল নার্সিং প্রয়োজন. রতন তখনই মায়ের মতো তার ভালো যত্ন নিতে শুরু করে। তিনি অবিলম্বে ডাক্তারকে ডাকলেন এবং তার পরে তাকে যথাযথ বিরতিতে ওষুধ দিলেন, তার জন্য রান্না করলেন এবং পোস্টমাস্টারের সমস্ত যত্ন নিলেন।

কিছুদিনের মধ্যে পোস্টমাস্টার সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু এখন আর সে একাকীত্ব সহ্য করতে পারছে না। তিনি উলাপুর থেকে বদলির আবেদন করেন।
আবার দরজার বাইরে তার আগের জায়গাটা তুলে নিল রতন। মাঝে মাঝে সে চুপিসারে ঘরের দিকে তাকাত যেন তার মনিব তার চেয়ারে বসে আছে বা তার বিছানায় শুয়ে আছে। রতন যখন কলের জন্য অপেক্ষা করতেন, পোস্টমাস্টার তার পাঠানো আবেদনের আনুষ্ঠানিক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতেন। রতন বারবার তার পাঠ পড়ত, পাছে সে ভুলে না যায়।

একদিন, পোস্টমাস্টার তাকে বলেছিলেন যে তিনি পদত্যাগ করেছেন এবং পরের দিন আর ফিরে না আসার জন্য বাড়িতে যাচ্ছেন। এই খবর শুনে তিনি হতবাক এবং অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। রাতের খাবারের পরে, তিনি পোস্টমাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি তাকে তার সাথে নিয়ে যেতে পারেন কিনা।

পোস্টমাস্টার হেসে বললেন, “কী ধারণা!” এটা তার দুঃখকে আরও গভীর করেছে। রতন তাকে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস না করে চলে গেল। সে রাতে সে ঘুমাতে পারেনি। সকালে, তিনি তার স্নান প্রস্তুত. স্নানের পরে, পোস্টমাস্টার তাকে ডেকে বললেন এবং চিন্তা করবেন না কারণ তিনি পরবর্তী পোস্টমাস্টারকে তার যত্ন নিতে বলবেন। তিনি কাঁদতে লাগলেন এবং তাকে বললেন যে তিনি আর সেখানে থাকবেন না। এতে পোস্টমাস্টার অবাক হয়ে যান।

পোস্টমাস্টার গল্প সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর:

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার কোন জায়গার লোক? তিনি কোথায় পোস্ট করা হয়েছিল?

উত্তর. পোস্টমাস্টার ছিলেন একজন শহরের বংশোদ্ভূত মানুষ। তিনি কলকাতার বাসিন্দা। তিনি একটি ছোট এবং প্রত্যন্ত গ্রাম উলাপুরে পোস্টড ছিলেন। কোনো সঙ্গ ছাড়াই তিনি পানির বাইরে মাছের মতো একাকী অনুভব করলেন।

প্রশ্ন . পোস্টমাস্টার গ্রামে কেমন লাগলো? তার মেজাজের জন্য দায়ী প্রধান কারণগুলি কি ছিল?
উত্তর. পোস্টমাস্টার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একাকী এবং অস্বস্তি বোধ করেছিলেন। তাকে পানির বাইরে মাছের মতো মনে হয়েছিল কারণ সেখানে তার কোন সঙ্গ ছিল না। তিনি একজন শহরের বংশোদ্ভূত যুবক ছিলেন এবং ছোট গ্রামে তার জীবনকে খুব নিস্তেজ এবং অসংলগ্ন দেখতে পেয়েছিলেন।

প্রশ্ন . পোস্টমাস্টার তার অবসর সময়গুলি যে উপায়ে ব্যয় করেছেন তা উল্লেখ করুন?
উত্তর. তরুণ পোস্টমাস্টারের অনেক অবসর সময় ছিল। গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে কবিতা লিখে সময় কাটাতেন। সে তার দাসী রতনকে শেখাতো, কিভাবে বই পড়তে হয়। তিনি বাড়িতে ফিরে তার নিজের পরিবার সম্পর্কেও তার সাথে কথা বলবেন বা রতনের অতীত জীবনের স্মৃতির কথা শুনবেন।

প্রশ্ন . রতন কে ছিলেন এবং পোস্টমাস্টারের জন্য তিনি কী করেছিলেন?
উত্তর. গ্রামের ছোট মেয়ে ছিল রতন। তিনি একজন এতিম ছিলেন যার নিজের কোন ঘর ছিল না। তিনি পোস্টমাস্টারের জন্য অদ্ভুত এবং সামান্য কাজ করবেন। তিনি পোস্টমাস্টারকে খুব পছন্দ করতেন এবং বাড়ির বাইরে বসে তার ডাকের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেন।

প্রশ্ন . রতন তার শৈশবের কোন দুটি ঘটনা মনে রেখেছিল?
উত্তর. বেত, ছোট্ট এতিম মেয়ে, পোস্টমাস্টারের কাছে তার শৈশব বর্ণনা করতে ভালবাসত। তার মনে পড়ে বাবা কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। দ্বিতীয়ত, পুকুরের ধারে মাছ ধরার সময় তার ছোট ভাইয়ের সাথে খেলার কথা মনে পড়ে।

প্রশ্ন . পোস্টমাস্টার কীভাবে রতনকে সাহায্য করেছিলেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টার প্রথমে গৃহহীন মেয়েটিকে তার দাসী হিসেবে নিযুক্ত করেন। রতনের সাথে তার খাবারও ভাগ করে নিতেন। অবশেষে, তিনি তাকে পড়তে শিখিয়েছিলেন। তার একাকীত্বের অনুভূতি এড়াতে তিনি তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন। ছোট্ট মেয়েটি পোস্টমাস্টারের সাথে সংযুক্ত হয়েছিল এবং তার সামনের শৈশবকে স্নেহের সাথে স্মরণ করেছিল।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার কীভাবে তার নিজের অনুভূতিগুলিকে “নিরন্তর পাখি” গানের সাথে যুক্ত করেছিলেন। পোস্টমাস্টার তার একাকীত্বের জন্য কী চেয়েছিলেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টারকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্ট করা হয়েছিল যেখানে তার কোনও সংস্থা ছিল না। তিনি তার নিজের একাকীত্ব এবং একঘেয়েমির অনুভূতিগুলি “অস্থির পাখি” গানের সাথে যুক্ত করেছিলেন। তিনি একটি “আত্মা” – একটি জীবন্ত মানুষ যাকে তিনি তার হৃদয়ের কাছে ধারণ করতে চেয়েছিলেন।

প্রশ্ন. রতন কীভাবে অসুস্থ পোস্টমাস্টারের দেখাশোনা করতেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লে রতন তৎক্ষণাৎ তার দেখাশোনা করতে থাকে। তিনি অবিলম্বে ডাক্তারকে ডেকেছিলেন এবং তারপর তাকে নিয়মিত বিরতিতে ওষুধ দেন। তিনি দিনরাত তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলেন এবং যতক্ষণ তিনি অসহায় এবং শয্যাশায়ী ছিলেন ততক্ষণ তিনি তাঁর খাবার রান্না করেছিলেন।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার কেন গ্রাম থেকে বদলির জন্য আবেদন করেছিলেন? তিনি কি তার বদলির আদেশ পেয়েছেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টার ঘটনাস্থলের অস্বাস্থ্যকরতার কারণে গ্রাম থেকে বদলির আবেদন করেন। এই আবেদন, মনে হচ্ছে বিভাগে কাজ করেনি এবং তিনি তার বদলির আদেশ পাননি। যাইহোক, তিনি তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কলকাতার উদ্দেশ্যে স্থান ত্যাগ করেন।

প্রশ্ন. ​​পোস্টমাস্টার কেন তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রতনের অনুরোধকে ‘অযৌক্তিক’ মনে করলেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টার ব্যবহারিক এবং স্বার্থপর ছিলেন। সে তার প্রতি রতনের অনুভূতিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। তার প্রতি তার ভালবাসা একটি শিশুর নির্বোধ স্নেহ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। তার সাথে তার মানসিক সংযুক্তির প্রতি তার সংবেদনশীলতার কারণে সে তার অনুরোধটিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে করেছিল।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার গ্রাম ছাড়ার আগে রতনকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন এমন দুটি উপায় কী ছিল?
উত্তর. কলকাতা যাওয়ার আগে পোস্টমাস্টার রতনকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। প্রথমে, তিনি রতনকে চিন্তা করবেন না কারণ তিনি তার উত্তরাধিকারীকে তার যত্ন নিতে বলবেন। দ্বিতীয়ত, গ্রাম ছাড়ার আগে, পোস্টমাস্টার তাকে তার মাসের বেতনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যা অবশ্যই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টারের দেওয়া আর্থিক সাহায্যের প্রতি রতনের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
উত্তর. কলকাতায় যাওয়ার আগে পোস্টমাস্টার রতনকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন এবং তার প্রায় পুরো মাসের বেতনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রতন তার কাছ থেকে কোনো টাকা নেবে না এবং তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না বলে পালিয়ে যায়। তিনি বিষণ্ণ বোধ করেছিলেন এবং শহরের বংশোদ্ভূত ব্যক্তির কাছ থেকে কোনও সাহায্য চাননি।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার কি ফিরে গিয়ে রতনকে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা ভেবেছিলেন?
উত্তর. যখন সে নদীর মাঝখানে ছিল, পোস্টমাস্টার ভেবেছিলেন ফিরে গিয়ে রতনকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। কিন্তু ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল এবং গ্রামটি ইতিমধ্যেই পিছিয়ে পড়েছিল। এর আগে অবশ্য তার মনে এমন কোনো চিন্তা ছিল না।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার কোন দর্শনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন?
উত্তর. পোস্টমাস্টার অনেক দেরি হয়ে গেলে রতনকে নিয়ে আসার কথা ভাবলেন। তিনি নিজেকে এই দর্শন দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে জীবন অগণিত সভা এবং বিচ্ছেদে পূর্ণ। তিনি মৃত্যুকেও প্রতিফলিত করেছিলেন যা ছিল মহান এবং চূড়ান্ত বিচ্ছেদ যা থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না।

প্রশ্ন. পোস্টমাস্টার চলে যাওয়ার পর রতন কী করেছিলেন? তার আশা কি ছিল?
উত্তর. পোস্টমাস্টার তার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে যান। দাদা চলে যাওয়ার পর রতন ডাকঘরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। সে আশা করেছিল তার দাদা একদিন গ্রামে ফিরবেন। তার সাথে তার দৃঢ় মানসিক বন্ধন তাকে এমন অনুভব করেছিল।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *